Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৫ মার্চ ২০২১

বঙ্গভবনের পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

 

 

‘বঙ্গভবন’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বাসভবন। এটি জাতির মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক। এ অঞ্চলের গণমানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি প্রদেশ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমিতে বঙ্গভবনের সূচনা হয়। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের শাসনামলে ভারত সাম্রাজ্যের অধিপতি ব্রিটেনের রাজার এক ঘোষণায় (Proclamation) ১৯০৫ সালের ০১ সেপ্টেম্বর এই নতুন প্রদেশ গঠিত হয় এবং ঢাকাকে রাজধানী করা হয়। নবসৃষ্ট প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা তথা লেফটেন্যান্ট-গভর্নর নিযুক্ত হন ইন্ডিয়ার সিভিল সার্ভিসের সদস্য স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার।

 

নবনিযুক্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নর ও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি উপযুক্ত অফিস ও বাসভবন নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অফিস ও বাসভবন নির্মাণের জন্য ঢাকার নবাব পরিবার দিলখুশা বাগানবাড়ির জমি প্রদানের প্রস্তাব দেন। স্যার খাজা সলিমুল্লাহ তখন ঢাকার নবাব ছিলেন। দিলখুশার দক্ষিণে গভর্নরের অফিস ও বাসভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ১৯০৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এই ভবনের কাজ শুরু হয়। উক্ত ভবন নির্মিত হবার পর এটি ‘অস্থায়ী গভর্নমেন্ট হাউজ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে ১৯০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত অস্থায়ী গভর্নমেন্ট হাউজে প্রবেশ করেন। মূলত এ দিন থেকেই বঙ্গভবনের যাত্রা শুরু। অচিরেই ভবনটি ‘দিলকুশা গভর্নমেন্ট হাউজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার ছাড়াও পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট-গভর্নর হিসেবে স্যার ল্যান্সলট হেয়ার, স্যার স্টুয়ার্ট বেইলি এবং তাঁদের পত্নীগণ এই অস্থায়ী গভর্নমেন্ট হাউজে বসবাস করতেন এবং ব্রিটিশ ঐতিহ্যে এটিকে সাজিয়ে তোলেন। ক্রমান্বয়ে এ ভবনটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। 

 

১৯১১ সালে ১২ ডিসেম্বর দিল্লী দরবার থেকে রাজা পঞ্চম জর্জের এক ঘোষণায় বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ১৯১২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বহু ব্রিটিশ গভর্নর ঢাকায় আসেন এবং গভর্নমেন্ট হাউজে অবস্থান করেন। সে সময় ঢাকাকে বাংলার দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে মনে করা হতো। ফলে এই হাউজের গুরুত্ব অব্যাহত থাকে। 

 

প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনাবসানের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ঢাকাকে এই প্রদেশের রাজধানী করা হয়। নতুন প্রাদেশিক শাসনকর্তার নামকরণ করা হয় ‘গভর্নর’ এবং তাঁর দপ্তর ও বাসস্থান নির্বাচিত হয় ব্রিটিশ আমলের দিলখুশা গভর্নমেন্ট হাউজ। এ সময় ‘গভর্নমেন্ট হাউজ’ এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় ‘গভর্নর হাউজ’। এটি প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে পরিণত হয়।

 

১৯৬১ সালের ৯ মে সারা প্রদেশে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গভর্নর হাউজের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় এবং ভবনটির আশু সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ে। তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আযম খানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালে গভর্নর হাউজটি নতুন আঙ্গিকে পুনঃনির্মাণ করা হয়। আধুনিক স্থাপত্যের নান্দনিক ছোঁয়ায় এ ভবনটি নবতর আঙ্গিকে প্রাসাদোপম আকারে গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন থেকে ১৯৭১ সালের সর্বশেষ গভর্নর ডা. এ. এম. মালিক পর্যন্ত গভর্নরগণ এ হাউজে অবস্থান করেন। 

স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে তা একদিনে অর্জিত হয়নি। এটি অর্জন করতে বাঙালিদের অনেক চড়াই-উৎরাই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অসীম সাহস, সঠিক দিকনির্দেশনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি অর্জন করে স্বাধীনতা।

 

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। বাঙালির আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন‍,‍‍ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে,  স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে বঙ্গবন্ধুর ০৭ মার্চের ভাষণ তার  এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ০৭ মার্চের ভাষণকে World’s Documentary Heritage-এর মর্যাদা দিয়ে Memory of the World International Register-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাঙালি হিসেবে আমরা এ জন্য গর্ববোধ করি।

 

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানী জান্তা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসা থেকে

 

গ্রেফতার করে এবং পাকিস্তানের মিনওয়ালী কারাগারে আটকে রাখে। বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দি অবস্থায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে।  তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। বিশ্ব মানচিত্রে সৃষ্টি হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। 

 

মুক্তিযুদ্ধকালীন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় যা ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাঁর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ-কে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ গভর্নর হাউজে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভা করেন।  সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গভর্নর হাউজকে ‘বঙ্গভবন’ নামে নতুন নামকরণ করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। 

 

ঢাকা শহরের মতিঝিল থানার অন্তর্গত দিলখুশা বাণিজ্যিক এলাকার দক্ষিণে ও মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ২৩.৫ হেক্টর জমির উপর বঙ্গভবন অবস্থিত। চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বাসভবন ছাড়াও রয়েছে উন্মুক্ত জায়গা, নানা প্রজাতির ফুল-ফল-ভেষজ ও বাহারি গাছের সমন্বয়ে মনোরম উদ্যান; হরিণ, বানরসহ নানা জাতের পাখপাখালি; পুকুর ও দিঘি। বঙ্গভবনে প্রবেশের মূলফটক পেরিয়ে উত্তরে রয়েছে বিশাল আম্রকুঞ্জ, দক্ষিণে নয়নাভিরাম গোলাপ বাগান। প্রধান ভবনের উত্তরে রয়েছে উন্মুক্ত একটি সবুজ চত্বর। মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদ্‌যাপনে এ চত্বরটি ব্যবহৃত  হয়। বিভিন্ন দেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতগণ তাঁদের পরিচয়পত্র পেশকালে এখানে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। মনোরম ও দৃষ্টিনন্দন এ খোলা চত্বরটি বঙ্গভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। বঙ্গভবনে দানাদিঘি, সিংহ পুকুর ও পদ্মপুকুর নামে তিনটি পুকুর রয়েছে। মৎস্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে এসব পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ হয়।

 

বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে রয়েছে শাহজালাল দখিনি (রঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মাজার। কথিত আছে পঞ্চদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সুফি হযরত শাহজালাল দখিনি (রঃ) এর সাথে বাংলার তদানীন্তন সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ’র বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়। এ বিবাদের ফলে সুলতানের সৈন্যসামন্ত শাহজালাল দখিনি (রঃ) ও তাঁর দলবলকে ৮৮১ হিজরীতে (১৪৭৫-৭৬ খ্রিঃ) আক্রমণ ও হত্যা করে। বঙ্গভবনের প্রধান ফটক পেরিয়ে উত্তর দিকে রাস্তার

পাশে হযরত শাহজালাল দখিনি (রঃ) এর সমাধি অবস্থিত। এছাড়াও আরো দু’টি মাজার রয়েছে যার একটি নওগোজি শাহ্ এবং অন্যটি চন্দন শাহ্ এর মাজার বলে ধারণা করা হয়।

 

বঙ্গভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন। মূলভবনে রয়েছে ঐতিহাসিক দরবার হল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এই দরবার হলে। রাষ্ট্রীয় সফরকালীন বন্ধুপ্রতীম দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণের সম্মানে দরবার হলে রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করা হয়। ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আয্হা, জন্মাষ্টমী, দুর্গাপূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন, বাংলা নববর্ষসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানমালা এ দরবার হলে অনুষ্ঠিত হয়। তখন বিভিন্ন সম্মানিত অতিথিদের আগমনে এ দরবার হল পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। কালের সাক্ষী এ দরবার হল তাই বঙ্গভবনের ঐতিহ্যবাহী স্মারক।

 

১৯০৫-১১ সময়ে  যে ঐতিহাসিক দিলখুশা গভর্নমেন্ট হাউজ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নমেন্ট-এর কার্যালয় ও বাসভবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘বঙ্গভবন’ নামে বাঙ্গালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রূপে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির অফিস ও বাসভবন হিসেবে তা এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করে। মূলত: বঙ্গভবনের সাথে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যা আগামী প্রজন্মকে আমাদের শিকড়ের সন্ধানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে। সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক বঙ্গভবন বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার স্মারক হিসেবে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

#২৩ মার্চ, ২০২১